জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার মধ্যে অন্যতম একটি হলো এইচ.এস.সি.পরীক্ষার পরের ভর্তি পরীক্ষা। এই পরীক্ষার পরই চলে আসে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যে সময়ে তোমার নেয়া একটিমাত্র সিদ্ধান্ত তোমার পুরো জীবনের দৃশ্যপটটাই বদলে দিতে পারে। আমরা ছোটবেলা থেকেই অবচেতন মনে নিজেদের নিয়ে কিছু স্বপ্ন লালন করি আর অপেক্ষা করতে থাকি কখন সেই সময় আসবে যখন সে অবাস্তব স্বপ্নটা বাস্তবে রূপান্তর হতে দেখতে পাবো।
একটা সময় সবগুলো ধাপ পেরিয়ে আমরা একদম দোরগোড়ায় এসে পৌঁছে যাই। কিন্তু এই সময়ে একটা ভুল সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনটাকে হতাশার বিশাল মহাসমুদ্রে ফেলে দিতে পারে!
ভর্তি পরীক্ষার আগের এই সময়টাতে তাই সবাই একটু না একটু দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায়- এখন কী করবো, কী করা উচিত কিংবা কী করলে ভালো হয় এই প্রশ্নগুলো নিয়ে। এইচ.এস.সি.পরীক্ষার পরে এই প্রশ্নগুলোয় নিজেদের জর্জরিত করতে করতে অনেকেরই মূল্যবান সময়ের বেশির ভাগই অপচয় হয়ে যায়। আজকের লেখাটি তাদের জন্যেই।
১। নিজের ইচ্ছা আর পরিবারের ইচ্ছার মধ্যে মতবিরোধ :
বর্তমানের একটি সাধারণ চিত্র এটি। ছোটবেলা থেকে আমরা নিজেদের মধ্যে কিছু স্বপ্ন লালন করি। কিন্তু আমাদের পরিবার তথা বাবা-মা তাঁরাও আমাদের নিয়ে কিছু স্বপ্ন লালন করে। মাঝেমাঝে পরিবারের স্বপ্ন আর আমাদের স্বপ্ন একই সুতোর গাঁথুনি হয়ে উঠে না। হয়তো ছেলে মেরিনে পড়তে চায়, পরিবার চায় সন্তান ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক। কিংবা মেয়েটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়, পরিবার চায় ডাক্তার হোক।
এমন পরিস্থিতিতে একজন পরীক্ষার্থীর কী করা উচিত? পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা কিছু করতে পারি না। এই ধরনের পরিস্থিতে তোমার কাছে দুটি অপশন থাকে-তোমার পরিবার তোমাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখে সে বিষয়ে নিজের আগ্রহ আর ভালোলাগা তৈরী করো আর নাহয় মা-বাবাকে তোমার অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব তোমার ভালোলাগার জায়গাটা কী সেটা বোঝানোর চেষ্টা করো।
তোমার মনের মধ্যে নিজেকে নিয়ে কী স্বপ্ন লালন করছো তা বুঝিয়ে বলো আর সে পথে ধরেই এগোও। তারা অবশ্যই বুঝবে। বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে জীবন নিয়ে সমঝোতা করে খুব বেশি দূর আগানো যায় না। মনে রাখবে, তারা তোমাকে কেন বোঝে না তুমি যেমন এই যুক্তি দিতে পারও, তেমনি তুমি নিজে বোঝাতে পারছোনা ঠিকভাবে তাই তারা বুঝছেনা এটাও কিন্তু আবার বলা যায়। বুঝে নেয়ার পাশাপাশি বোঝানাটাও কিন্তু অনেক বড় একটা ব্যাপার। সেই বোঝানো টা বোঝাতে হয় মমতার ভাষায়, ভালোবাসার মধ্য দিয়ে, কখনোই কঠিনভাবে কিংবা ঝগড়া-বিবাদের মধ্য দিয়ে নয়। মনে রেখো, তারা গ্রেটেস্ট হলেও তুমি কিন্তু লেটেস্ট। তাই, মতের অমিল হলে বুদ্ধিমত্তার সাথে ডিল করতে পারাটাও কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ তোমার গোটা জীবনের জন্য।
২। কোথায় পড়লে ভালো হয় ?
ভর্তি পরীক্ষার আগে স্টুডেন্টদের করা সব থেকে কমন প্রশ্ন- কোন কোচিংয়ে পড়লে ভালো হয়? আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার সাথে কোচিং সেন্টারের খুব বেশি একটা সংযোগ নেই। কোচিং সেন্টার আমাদের পড়ার ক্ষেত্রে শুধু দিক নির্দেশনা দিতে পারে কিন্তু চান্স পাওয়ার জন্য পড়াশোনা তোমার নিজেরই করতে হবে।
কোচিংয়ে পড়া এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক না। এমনকি কোনো কোচিংয়ে না পড়েও চান্স পাওয়া সম্ভব। আমি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার জন্য কোনো কোচিং সেন্টারে পড়ি নি। তবে সেক্ষেত্রে পড়ার প্রতি তোমার আন্তরিকতা থাকতে হবে। যা পড়ছো তা যেন ফলপ্রসূ হয়। মনে রাখবে ভর্তি পরীক্ষায় সব সময়, ‘Quality demands, not quantity’ .
৩। মনকে প্রাধান্য দেবো নাকি বিবেককে ?
জীবনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় খুব দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যাই! যেমন ধরো, তুমি বুয়েট কিংবা মেডিকেলের প্রস্তুতি নিলে, কিন্তু রেজাল্ট দেয়ার পর দেখলে তোমার হলো না। তুমি ভাবছো তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগরসহ আরো বেশ কিছু সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম তুলে রাখো। মনের জোরে পরীক্ষাগুলো না হয় দিয়েই দাও! বিগত বছরের প্রশ্নগুলো দেখে যে কয়দিন থাকে প্রস্তুতি নিতে শুরু করো। হতে পারে প্রথমবার ব্যর্থ হওয়া এই তুমিই পরের পরীক্ষাগুলোর সব ক’টায় টিকে গেলে!
কিংবা ধরো, একসাথে একের অধিক জায়গায় চান্স পেলে তুমি। তুমি যেকোনো একটা জায়গাতেই শুধু হতে ভর্তি হতে পারবে। কারণ, একসাথে একাধিক জায়গায় পড়ার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে কী হবে তোমার সিদ্ধান্ত? তোমার ইন্টারেস্টের জায়গাটা খুঁজে বের করো, কী নিয়ে তোমার পড়তে ভালো লাগে। কারণ চার/পাঁচ বছর তোমার সেই বিষয়টা নিয়েই পড়তে হবে। ভালো লাগা না থাকলে সাফল্যের মুখ দেখাটা আসলে কষ্টসাধ্য ব্যাপার!
“Trust your instincts and make judgments on what your heart tells you. The heart will not betray you.”
― David Gemmell
৪। ঝুঁকি নেয়ার সাহসিকতা :
যদি এর আগে কোনো প্রকার ঝুঁকি নেয়ার অভিজ্ঞতা না থাকে, তবে জীবনের এই পর্যায়ে এসে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে একটা ঝুঁকি নাহয় নিয়েই ফেলো। তুমি খুবই দ্বিধায় ভুগছো কোন জায়গার প্রিপারেশন নিবে,ভার্সিটির নাকি মেডিকেলের। এবার ভালোলাগার গুরুত্বের উপর ভিত্তি করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলো!
পাওলো কোয়েলহো এর লেখা বিশ্ববিখ্যাত ‘দ্যা আলকেমিস্ট’ বইটিতে প্রধান চরিত্র সান্তিয়াগোও কিন্তু ঝুঁকি নিয়েই পিরামিডের মধ্যে থাকা গুপ্তধনের খোঁজে বের হয়েছিল। আর পথিমধ্যে অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলোই তার বাকি জীবনের পাথেয় রূপে কাজ করেছিল। পৃথিবীতে অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত যুগান্তকারী যা কিছু হয়েছে সেসবই কিন্তু সঠিক সময়ে নেয়া সঠিক কিছু সিদ্ধান্তের ফলাফল।
“Take risks. If you win, you will be happy; If you lose, you will be wise.”
৫। ভয়কে করো জয় !
Michelle Obama লন্ডনের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেয়ার সময় বলেছিলেন,
“You can’t make decisions based on fear and the possibility of what might happen. You have to remind yourself that you have to do it.”
সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় মনে ভয় আর সংশয় রেখো না। পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার সময় নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে দাও, পরীক্ষার পরে যাতে তোমার নিজেকে নিয়ে কোনো আফসোস না থাকে। তোমার যাতে এমন মনে না হয়, হয়তো আরেকটু ভালোভাবে পড়লে চান্সটা পেয়ে যেতে তুমি! তাই প্রস্তুতি নেয়ার জন্য যে কয়দিনই পাও না কেন, চেষ্টায় গাফিলতি রেখো না। অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আর তোমার আন্তরিক প্রচেষ্টায় যথাসময়ে তুমি নিজের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।
মূল বই না পড়ে দিন-রাত ফেইসবুকে পড়ে থাকলে আর চ্যাটিং করলে কেবল ফেইসবুকে ফ্রেন্ডলিস্ট দীর্ঘ হতে পারে; চান্স নয়। চান্স পেতে হলে পরিশ্রম করতে হয় , নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয় । তারপর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলেই চান্স পাওয়া সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাকে একটি যুদ্ধক্ষেত্র বলা যায় । ১৩ লক্ষ পরীক্ষা দিবে ৪৮ হাজার চান্স পাবে মাত্র । সো বুঝতেই পারতেছে নিজেকে কিভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।
কেবল সাময়িক আনন্দের মোহের জীবনটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছো না তো? একদিন রাতে দরজা-জানালা বন্ধ বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে একাকী নিজেকে নিয়ে ভাবুন। তুমি আসলে কী হতে চাও? জীবনে আসলে কী পেতে চাও ? নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জীবনে কিছু করতে না পারলে বাকি জীবনটা কীভাবে চলবে? এইভাবেই চলবে তো?
0
0
0