গ্রহ, বামন গ্রহ ও ক্ষুদ্র সৌরজাগতিক বস্তু। এক ক্ষুদ্র বস্তু গুলোর মধ্যে আছে গ্রহাণু, ধুমকেতু এবং অন্তঃগ্রহী ধূলি মেঘ।
সূর্য (The sun)
সূর্য মূলত একটি নক্ষত্র। একটি গ্যাসীয় পদার্থ দ্বারা তৈরি একটি অতি মাত্রায় উত্তপ্ত ও উজ্জ্বল বস্তু। এর ভর 2 x 10^30 Kg,গড় ব্যাসার্ধ 6.95 x 10^8 m এবং ঘনত্ব1410 Kg.m^-3. এর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা 5700 degree সেলসিয়াস কিন্তু ভেতরের তাপমাত্রা দেড় কোটি ডিগ্রী সেলসিয়াস। সূর্যের ভেতরে হাইড্রোজেনের ফিউশনের ফলে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। সূর্য তার নিজ অক্ষের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে সময় নেয় 25 দিন।পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব 15 কোটি কিলোমিটার। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় আট মিনিট। সূর্য প্রতি সেকেন্ডে 4 x 10^26 J শক্তি বিকিরিত করে।
গ্রহ (The planet)
সৌরজগতে গ্রহের সংখ্যা আট। গ্রহগুলোর সূর্যকে একটি ফোকাসে রেখে বিভিন্ন উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। গ্রহের নিজস্ব কোন আলো নেই। সূর্য থেকে চাঁদের দূরত্ব অনুসারে গ্রহ গুলো হল -
১. বুধ
২. শুক্র
৩. পৃথিবী
৪. মঙ্গল
৫. বৃহস্পতি
৬. শনি
৭. ইউরেনাস
৮. নেপচুন
এর মধ্যে প্রথম চারটিকে পার্থিব গ্রহ এবং শেষ চারটিকে গ্যাসীয় দানব বলে। ৬ টি গ্রহের নিজিস্ব প্রাকৃতিক উপগ্রহ আছে। বুধ ও শুক্রের কোন উপগ্রহ নেই। উপগ্রহ সূর্যের পরিবর্তে গ্রহ বা বামন গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘোরে। চাঁদ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। মঙ্গল ও নেপচুনের দুটি করে, ইউরেনাসের পাঁচটি, শনির দশটি এবং বৃহস্পতির 12 টি উপগ্রহ আছে।
বামন গ্রহ(Dwarf planet)
বামন গ্রহ গ্রহের মতোই সূর্যের চারদিকে ঘোরে। কিন্তু গ্রহ এবং বামন গ্রহের মধ্যেে মুল পার্থক্য হচ্ছে :-
১. সধারনত গ্রহের কক্ষপথ পরিষ্কার থাকে কিন্তু বামন গ্রহের কক্ষপথ পরিষ্কার থাকে না।
২.বামন গ্রহগুলো গ্রহের তুলনায় অসম্পূর্ণ হয়।
এপর্যন্ত সন্ধানে প্রাপ্ত বামন গ্রহের সংখ্যা তিনটি। যথা :-
১. প্লুটো
২. সেরেস
৩. এরিস
বামন গ্রহের উপগ্রহ আছে। জ্যোতির্বিদ ক্লাইভ টমবার্গ কর্তৃক প্লুটো আবিষ্কারের পর একে গ্রহ বলে বিবেচনা করা হলেও 2006 সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কর্তৃক নির্ধারিত গ্রহের নতুন সংজ্ঞায় এটি বামন আওতায় এটি বামন গ্রহ হিসেবে চিহ্নিত হয়। ভবিষ্যতে সৌরজগতের আরও কিছু বস্তু বামন গ্রহের মর্যাদা পেতে পারে।
গ্রহাণুপুঞ্জ (Asteroids)
গ্রহ, বামন গ্রহ ছাড়াও বিষম আকৃতির কিছু বস্তু সূর্যকে আবর্তন করছে এদেরকে বলা হয় গ্রহাণু। এরূপ অসংখ্য পাথুরে গ্রহাণুগুলো মঙ্গল ও বৃহস্পতির কক্ষপথের মাঝে সূর্যের চারদিকে একটি বৃষ্টির মতো তৈরি করেছে একে গ্রহাণু বলে। গ্রহানু বেষ্টনীতে 10 থেকে 20 হাজার বস্তুর আছে যাদের ব্যাস এক কিলোমিটারের উপরে। এ সংখ্যা মিলিয়নও হতে পারে। তারপরও সমগ্র পৃথিবীর ভরের হাজার ভাগের এক ভাগ অপেক্ষা সামান্য বেশি।
ধুমকেতু (Comets)
ধুমকেতু বেশ ছোট উদ্বায়ী বরফ দ্বারা গঠিত সৌরজাগতিক বস্তুু। এদের ব্যাস কয়েক কিলোমিটার। এদের কক্ষপথ অতিমাত্রায় উৎকেন্দ্রিক। এদের অনুসুর ( সূর্য থেকে ন্যূনতম দূরত্ব) বিন্দু সৌরজগতের অভ্যন্তরের (সূর্য থেকে মঙ্গল গ্রহ পর্যন্ত অংশকে সৌরজগতের অভ্যন্তর ধরা হয়) কাছাকাছি। কিন্তু অপসুর ( সূর্য থেকে সর্বোচ্চ দূরত্ব) বিন্দু প্লুটোর কক্ষপথেরও বাইরে। ধুমকেতু সৌরজগতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে সূর্যের কাছাকাছি হওয়ায় এর বরফসমৃদ্ধ পৃষ্ঠতল আয়নিত ও ঊর্ধ্বপাতিত হয়ে একটি লেজ গঠন করে। তাই তখন এদেরকে দেখতে অনেকটা ঝাটার মতো মনে হয়। গ্যাস ও ধুলি দিয়ে গঠিত এই লেজটি অনেক সময় খালি চোখেও দেখা যায়।
উল্কা(Meteors)
অনেক সময় রাতের বেলা আগুনের গোলার মতো কিছু একটা পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসতে দেখা যায়। যা খুব অল্পসময়ের মধ্যে নিভে যায় একে উল্কা বলে। উল্কা মূলত গ্রহাণু যাদের ব্যাস 10 থেকে 10 হাজার মিটার। এরূপ শিলাখণ্ড কোন কারণে পৃথিবীর কাছাকাছি এসে গেলে অভিকর্ষ বলের প্রভাবে যখন প্রবল বেগে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে তখন বায়ুর সাথে ঘর্ষণের ফলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠে পতনের পূর্বে নিঃশেষ হয়ে যায়।
কাইপার বেষ্টনী
সৌরজগতের একবারে বাইরের দিকে গ্রহাণু বেষ্টনীর মতোই সূর্যের 30 AU দূরত্ব থেকে 50 AU দূরত্ব পর্যন্ত বিভিন্ন বস্তুর এক বিশাল আছে যাকে কাইপার বেষ্টনী বলে। এখানকার, বস্তুগুলো অধিকাংশই সৌরজগতের বস্তু শ্রেণীর মধ্যে পড়ে। এখানে অবস্থিত বস্তুগুলোকে ধ্বংসাবশেষ বলা যায়। এগুলো মূলত বরফশীতল বস্তু দ্বারা গঠিত। এই বেষ্টনীতে দশ হাজারেরও বেশি সংখ্যক বস্তুু আছে যাদের ব্যাস 50 কিলোমিটারে উপরে। কিন্তু এদের সমন্বিত ভর পৃথিবীর ভরের এক দশমাংশ অপেক্ষা কম।
নক্ষত্র (Star)
আমরা মেঘমুক্ত রাতের আকাশে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উজ্জ্বল বস্তুকে মিটমিট করে জ্বলতে দেখি এগুলোই তারা বা নক্ষত্র। সূর্য একটি নক্ষত্র। সূর্যের মতো অন্যান্য নক্ষত্রের ও নিজস্ব আলো আছে। নক্ষত্রগুলোকে ক্ষুদ্র দেখলেও আসলে এরা কিন্তু ক্ষুদ্র নয়, এগুলো আমাদের থেকে অনেক দূরে তাই ক্ষুদ্র দেখা যায়। এদের অধিকাংশই সূর্য অপেক্ষা বড়। এদের জন্ম ধুলি ও গ্যাসের বিশাল সমাহার থেকে। মহাকর্ষের টানে ধুলি ও গ্যাসের বিশাল সমাহার একত্রিত হয়ে যখন নক্ষত্রের তাপমাত্রা কয়েক মিলিয়ন কেলভিন হয় তখন এটি প্লাজমা অবস্থা ধারণ করে।এ সময় এতে অবস্থিত হাইড্রোজেনের ফিউশন শুরু হয় ফলে এতে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয় এবং আলো ছাড়তে শুরু করে অর্থাৎ তখন এটি নক্ষত্র রূপে আবির্ভূত হয়।
নীহারিকা বা নেবুলা (Nebula)
নীহারিকা হচ্ছে ধূলিকণা, হাইড্রোজেন গ্যাস এবং প্লাজমা দ্বারা গঠিত এক ধরনের আন্তঃনাক্ষত্রিক সুবিশাল আকারের মেঘ। একসময় আকাশগঙ্গার বাইরে ছায়াপথ সহ যেকোন ধরনের বিস্তৃত জ্যোতির্বিজ্ঞানীক বস্তুর সাধারণ নাম ছিল নীহারিকা । যেমন:- অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথকে পূর্বে অ্যানড্রোমিডা নীহারিকা বলা হতো। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা এ যে ধূলিকণা ও হাইড্রোজেন গ্যাসের সুবিশাল আকৃতির মেঘ বা নীহারিকা থেকেই নক্ষত্রের জন্ম। পরিষ্কার রাতের আকাশে তাকালে কোথাও কোথাও আবছা আলো ফুটে উঠেছে এগুলোই নীহারিকা। বিভিন্ন ধরনের নীহারিকা আছে যেমন :-
কালপুরুষ, ঘোড়ার মাথা, ওমেগা নীহারিকা (Omega Nebula),বিড়াল চোখ নীহারিকা, কাঁকড়া নীহারিকা, লাল চতুঁর্ভুজ নীহারিকা ইত্যাদি। অনেক সময় সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকেও নীহারিকার জন্ম নেয়। এরূপ একটি নীহারিকা হচ্ছে :-
কাঁকড়া নীহারিকা। কিছু নীহারিকা আবার উজ্জ্বল আবার কিছু নীহারিকা অনুজ্জ্বল। ঘোড়ার মাথা নীহারিকাটি অনুজ্জল ঘোর অন্ধকার হয়। যেমন: ঘোড়ার মাথা নীহারিকাটি অনুজ্জ্বল রাতের আকাশে একে কালো ঘোড়ার মতো মনে হয়।
ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি(Galaxy)
দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় মহাকাশের কোথাও কোথাও বস্তু পুঞ্জের সমন্বয়ে বড় বড় দল গঠিত হয়েছে। বস্তুসমূহের এরূপ দল বা সমষ্টিকে বলা হয় গ্যালাক্সি। গ্যালাক্সিতে আছে অসংখ্য নক্ষত্র আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস ও ধূলিকণা প্লাজমা এবং প্রচুর পরিমাণে অদৃশ্য বস্তু। অর্থাৎ গ্যালাক্সিতে অসংখ্য আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূলিকণা এবং প্রচুর পরিমাণে অদৃশ্য বস্তু এক বিশাল সমাহার।
গ্যালাক্সির ব্যাস কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত একটি গ্যালাক্সিতে 10 মিলিয়ন থেকে 100 বিলিয়ন নক্ষত্র থাকে এটা নির্ভর করে গ্যালাক্সির সাইজের উপর। ছোট গ্যালাক্সি গুলোকে বলা হয় বামন গ্যালাক্সি আর বড় গ্যালাক্সিগুলো কে বলে দানব গ্যালাক্সি। আমাদের সৌরজগতে একটি গ্যালাক্সির অন্তর্ভুক্ত। এর নাম হচ্ছে আকাশগঙ্গা। অন্ধকার রাতের আকাশে আকাশগঙ্গাকে মনে হয় একটি সাদা রংয়ের পথ আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে গেছে। 1610 সালে গ্যালিলিও টেলিস্কোপ এর সাহায্যে প্রথম এটি পর্যবেক্ষণ করেন এবং তিনি জানিয়েছিলেন যে সাদা রঙের এ পথটি অসংখ্য অনুজ্জ্বল ও উজ্জ্বল নক্ষত্র দিয়ে গঠিত।
গ্যালাক্সি বিভিন্ন আকার আকৃতির হতে পারে যেমন : উপবৃত্তাকার, সর্পিল ও বিষম। শতকরা 80 ভাগ গ্যালাক্সি দেখতে উপবৃত্তাকার। এগুলো সাধারণত লোহিত দানব ও শ্বেত বামন নক্ষত্র দিয়ে গঠিত। মোট গ্যালাক্সির 80 শতাংশ পেচানো বা সর্পিল। আমাদের আকাশগঙ্গা ও অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি এ ধরনের গ্যালাক্সি। এদের রয়েছে উজ্জ্বল কেন্দ্রীয় অঞ্চল যেখানে গ্যালাক্সির অধিকাংশ ভর জমা থাকে। আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে 2.77 x 10^3 আলোকবর্ষ দূরে কালপুরুষ বাহুতে আমাদের সৌরজগৎ অবস্থিত।
বিষম গ্যালাক্সির নির্দিষ্ট কোন আকার নেই 2 শতাংশ গ্যালাক্সি বিষম আকৃতির।
আবার কিছু গ্যালাক্সি থেকে প্রচুর মাত্রায় বেতার তরঙ্গ বিকরিত হতে দেখা যায় এরূপ গ্যালাক্সিকে রেডিও গ্যালাক্সি বলে। সাধারণত রেডিও গ্যালাক্সি দু'পাশে দুটি অংশে থাকে (যা দেখতে অনেকটা মানুষের মাথার দুপাশে দুটো কানের) মতো যেখান থেকে 10 MHz থেকে 100 GHz কম্পাঙ্কের তরঙ্গ বিকরিত হয়। সাধারণ গ্যালাক্সি থেকে রেডিও গ্যালাক্সির পার্থক্য হচ্ছে এদের রেডিও রেডিও উজ্জ্বল্য বা রেডিও ক্ষমতার আউটপুট প্রায় 10^38 W যেখানে সাধারন গ্যালাক্সির রেডিও ক্ষমতার উজ্জ্বল্য আউটপুট 10^32 W.
কোয়াসার হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের রেডিও গ্যালাক্সি। আধা নক্ষত্রিক নক্ষত্র বা নক্ষত্র সদৃশ রেডিও উৎস থেকে কোয়াসার শব্দটি এসেছে। এ জ্যােতিষ্কটি তড়িৎ চুম্বক শক্তির উৎস যার আলো উজ্জ্বল মাএার লাল অপসারণ প্রদর্শন করে। যার অর্থ দাঁড়ায়(হাবলের নীতি অনুসারে) এগুলো আমাদের থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে এবং এগুলো আমার থেকে খুব বেশি বেগে (প্রায় 0.9c) দূরে সরে যাচ্ছে। এগুলো এত দূরে যে এদেরকে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সীমানা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোয়াসার হলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তু যা টেলিস্কোপ এর বিন্দুমাত্র ধরা পড়ে। এদের উজ্জ্বল্যতা গড় আকৃতির কয়েকশো গ্যালাক্সির মিলিত উজ্জ্বলতার থেকেও বেশি। 1970 সালে প্রথম কোয়াসার আবিষ্কৃত হয়। এ পর্যন্ত 150 টি কোয়াসারের সন্ধান পাওয়া গেছে।
0
0
0